মীর জাহিদ: দীর্ঘ বছর একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হিসেবে কাজ করতে যেয়ে নানা ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে । যার মধ্যে অনেক ঘটনায় গতানুগতিক। আবার এমন কিছু ঘটনা রয়েছে যা সহজেই ভুলবার নয় ।
তবে এটি ঠিক আর্থিকভাবে সাধারণ গরীব মানুষগুলো ( ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে ) যে কতোটা অসাধারণ তাঁদের সাথে কাজ করার সুযোগ না হলে হয়তো তেমনভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম না ।
সময়টা সঠিক মনে নেই তবে ৪/৫ বছর আগে হয়তোবা । অফিস চলাকালীন সময়ে একজন জীর্ণ পোশাক পরিহিত এক ভদ্রলোক আমার কক্ষে এলেন একজন ভদ্রমহিলার কাঁধে ভর দিয়ে । সঙ্গে ছিল দু’টি ছোট বাচ্চা ।
কি সমস্যা জানতে চাইলাম। অঝোরে কাঁদতে ছিলেন ভদ্রমহিলা। অবশেষে নিজকে সংবরণ করে ভদ্রমহিলা বললেন ” ইনি আমার স্বামী । পেশায় একজন বাই- সাইকেল মেরামত ও স্পার্টস বিক্রয়ের ক্ষুদ্র দোকানী। স্বচ্ছল না হলেও ব্যাবসা মোটামুটি ছিল। যা দিয়ে তাঁদের পরিবার একরকম ভালোই চলতো ।
হঠাৎ কি এক রোগে তাঁর একটি পা প্যারালাইজ হয়ে গেছে । অনেক টাকা চিকিৎসা বাবদ খরচ করেও দু’পায়ে দাঁড়াতে পারেন না তিনি । এখনও তিনি ভীষণ অসুস্থ। স্ক্রেচে ভর দিয়েও তিনি একাএকা চলতে পারেন না । চিকিৎসা করতে যেয়ে তাঁরা আজ নিঃস্ব।
এখন চিকিৎসা করার অর্থ জোগাড় করা দুরূহ হয়ে পড়েছে । এমনকি কোন কোন দিন দু’বেলা খাবারও জোগাড় করতে পারন না ……”
এসব কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ বেয়ে পানি ঝরতে থাকলো ।
ভদ্রলোক ( যিনি তাঁর স্বামী ) কোন কথায় বলতে পারছেন না । নির্বাকভাবে অসহায় চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন । সে নির্বাক চাহনি ও তাঁর স্ত্রীর চোখের পানি সব মিলে কিংকর্তব্য বিমুড় হয়ে পড়লাম।
জিজ্ঞাসা করলাম তাঁদের জন্য আমি কি করতে পারি ।
ভদ্র মহিলা বললেন, ” তাঁর স্বামীর ব্যাবসার উপর ৪/৫ লক্ষ টাকা ঋণ নেয়া আছে । এখন সুদে আসলে অনেক হয়ে গেছে । একদিকে দু’বেলা খাবার জোটাতে পারেন না , পারেন না স্বামীর চিকিৎসার অর্থ জোগাড় করতে অন্য দিকে তাঁর ভাসুর- দেবররা ঋণটি পরিশোধের জন্য ভীষণ চাপ দিচ্ছেন। প্রতি নিয়মিত অসৌজন্যমূলক আচরণ করছেন। কারণ ঋণের বিপরীতে যে জমিটি মর্টগেজ দেয়া আছে সেটি তাদের পিতার জমি । যেখানে তাঁর ভাইদের মালিকানা আছে ।
এই মানুষিক নিপিড়ন থেকে তাঁর স্বামীকে বাঁচাতে চান তিনি ।
তিনি ঋণের টাকা পরিশোধ করতে চান এবং জানালেন কিছু টাকা সুদ মওকুফ করে দিলে তিনি ঋণ টি একবারে পরিশোধ করে দিবেন। “
জানতে চাইলাম কি করেন তিনি । কাঁদতে কাঁদতে বললেন, লোকের বাড়িতে কাজ করেন।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কিভাবে পরিশোধ করবেন তিনি এতো টাকা তাও আবার একবারে !
তিনি বললেন ” পৈত্রিক সূত্রে তিনি কিছু জমি পাবেন, সেটি তাঁর বাবা ও ভাইয়েরা বিক্রী করার জন্য খদ্দের ঠিক করেছেন। কিন্তু তা দিয়ে পুরো ঋণ পরিশোধ হচ্ছে না । আবার তাঁর বাবা- ভাইদের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয় ।
বিপন্ন পরিবার , বোন এর প্রতি ভাইদের ভালোবাসা , বেঁচে থাকার আকুতি , স্বামীর প্রতি আকুণ্ঠ ভালোবাসা , শেষ সম্বল বিক্রী করে তাঁর স্বামীকে রক্ষা করার প্রানান্ত চেষ্টা সবকিছু আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিল ।
আরও কিছু কথা হলো । সেখানে আমার কয়েকজন সহকর্মী উপস্থিত ছিলেন। রুমের পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠলো ।
আমি তাঁকে কথা দিলাম, নিয়মের মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ যতোটা সম্ভব ততটুকু সুদ মওকুফ করার চেষ্টা করা হবে।
হ্যাঁ , ঊনি যতটুকু চেয়েছিলেন সে সুদটুকু মওকুফ করা গিয়েছিল। আমি তার কিছুদিন পর অন্য জায়গায় বদলী হয়েছিলাম। আমার সহকর্মীরা ফোন করে জানিয়েছেন, ঋণটি তিনি তাঁর মতোই পরিশোধ করেছেন।
সদাশয় পরিচালনা পর্ষদও পোষ্ট ফেক্টর অনুমোদন দিয়েছেন।
যা হউক, ওদের বাড়ী কোথায় আমার জানা ছিল না ।
কিন্তু মাঝে মধ্যে মনে পড়তো ঔ পরিবারটির কথা । কেন জানি জানতে ইচ্ছে করতো কেমন আছে তাঁরা ।
আমি একজন সহকর্মীর সহযোগিতায় কিছুদিন আগে একদিন তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ছেলেটি দশম শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে , মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণীতে ।
ভদ্রলোক আমাকে দেখে ভীষণ খুশী ।
তাঁর একটি পা খুব চিকন হয়ে গেছে । আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। দোকানটি আছে জানালেন। চলাফেরা এখনও স্বাভাবিক ভাবে করতে পারেন না , তাই তাঁর স্ত্রী দোকানে যেতে দেন না। আবার দোকানে মালামাল নেই বললেই চলে ।
তাঁর স্ত্রীই পরিবার এর হাল ধরেছেন। বাড়ীর মধ্যেই সেলাই মেশিন এর কাজ, জামা কাপড় বিক্রী , মুরগি পালন করেন।
এবার দু’জনকেই কাঁদতে দেখলাম । দেখলাম চোখের পানিতে খুশির আনন্দ, সুখের আনন্দ।
( বিঃদ্রঃ এখানে আমার ব্যাক্তিগত কোন অবদান নেই।
শুধুমাত্র সরকারী নির্দেশনা পরিপালন করার চেষ্টা মাত্র)
লেখকঃ সোনালী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক